আইপিএল ২০২৫-এর মঞ্চে একদমই স্বরূপে নেই রোহিত শর্মা। ছন্দে না থাকা, রান না পাওয়া, আর বারবার হতাশাজনকভাবে আউট, সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, রোহিত কি তবে নিজের সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন?
মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের সাবেক অধিনায়ক এবং ভারতের ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি দলের বর্তমান নেতা এবার আইপিএলে ছয় ইনিংসে করেছেন মাত্র ৮২ রান। গড়? মাত্র ১৩.৬৬! সবচেয়ে বড় ইনিংসটি ২৬ রানের, সেটাও এসেছে সর্বশেষ ম্যাচে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে। ১৬ বলের ওই ইনিংসে ছিল তিনটি ছক্কা, কিছুটা ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিলেও প্যাট কামিন্সের বলেই আবারও সহজভাবে আউট হয়ে যান রোহিত।
রোহিতের অফফর্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টালমাটাল মুম্বাই ইন্ডিয়ানসও। ৭ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে এখন তারা পয়েন্ট টেবিলের সাত নম্বরে। ঠিকমতো জয়ের ধারায় ফিরতে পারছে না টিম ডেভিড-সুর্যকুমাররা।

তবে এই ব্যর্থতা শুধুই আইপিএল ঘিরে। কারণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিত এখনো বেশ সফল, ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও সদ্য শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে শিরোপা ঘরে তুলেছে ভারত, নেতৃত্বে ছিলেন রোহিতই।
আর মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের ইতিহাসে রোহিত তো এক কিংবদন্তি, ১১ বছরে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাঁচটি শিরোপা জিতে। ওয়াংখেড়েতে তার নামে একটি গ্যালারি চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
কিন্তু এত সাফল্যের সঙ্গেই আসে বিশাল প্রত্যাশা। আর সেই প্রত্যাশার ভারই হয়তো কাঁধে চেপে বসেছে রোহিতের। গত কয়েক মৌসুমে রোহিতের আইপিএল পারফরম্যান্সে স্পষ্ট পতনের ধারা। এখন প্রশ্ন রোহিত কী করবেন পরের ধাপে? মুম্বাই-ই বা কীভাবে সামলাবে এই অবস্থান?
কি বলছে রোহিতের পরিসংখ্যান
রোহিত শর্মার আইপিএল ক্যারিয়ারে গড় রান ২৯.৩০। তবে ওপেনার হিসেবে ২০২২ সাল থেকে সেই গড় নেমে এসেছে ২২.৮৯-এ। এই সময় অন্তত ২০ ইনিংস খেলা ২১ জন ওপেনারের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন গড়।
চলতি আসরে ছয় ম্যাচে রোহিতের গড় মাত্র ১৩.৬৬। যদি ২০২৪ সালের শেষ তিন ম্যাচের পারফরম্যান্সও ধরেন, তাহলে এই গড় আরও কমে দাঁড়ায় ১২.৮৯!
তবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রোহিতের এমন পতন নেই। ২০২২ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার গড় ২৯.৩৪, আইপিএলের ওপেনার হিসেবে যে গড় (২২.৮৯) তার চেয়ে অনেকটাই ভালো।
আসলে রোহিতের আইপিএলে সেরা সময়গুলো এসেছে ওপেনিংয়ের বাইরে, মিডল অর্ডারে। নম্বর পাঁচে তার গড় ৩৩.১১ এবং চার নম্বরে ৩২.৭। ওপেনার হিসেবে ক্যারিয়ার গড় ২৭.৭৪, যেখানে ২০১৬ ও ২০২৪ মৌসুমেই কেবল ৩০-এর বেশি গড় তুলতে পেরেছেন (যেখানে অন্তত পাঁচ ইনিংস খেলেছেন)।
রোহিতের ব্যর্থতার পেছনে কী কারণ?
রোহিত শর্মার আইপিএলে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পেছনে কেবল ‘ফর্মে নেই’ বললে পুরোটা বলা হয় না। পরিসংখ্যান বলছে, তার ব্যাটিংয়ে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এসেছে, যেগুলোই মূলত তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাওয়ারপ্লেতেই ভাঙছে গার্ড
২০২২ সাল পর্যন্ত পাওয়ারপ্লেতে (প্রথম ৬ ওভার) পেসারদের বিপক্ষে রোহিতের গড় ছিল ৩৬.৪৭, এখন সেটা নেমে এসেছে ২৪.৩৯-এ। ২০২৩ সাল থেকে ৩৬ ইনিংসে মাত্র ১২ বার পাওয়ারপ্লে টপকাতে পেরেছেন। চলতি মৌসুমে এখনো একবারও পাওয়ারপ্লে পার হতে পারেননি।
লেগ সাইড নির্ভরতা বেড়েছে
এক সময় রোহিত ছিলেন 'ব্যালান্সড' ব্যাটার, ৫১% রান আসত লেগ সাইডে, এখন সেটা বেড়ে ৫৯%। এই একচেটিয়া লেগ সাইড খেলার প্রবণতাই হয়তো আউটসুইং ডেলিভারিতে তার সংগ্রাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
আউটসুইংয়ে বিপর্যয়
২০২২ সালের আগে আউটসুইংয়ের বিপক্ষে গড় ছিল প্রায় ৫০, এখন সেটা নেমে এসেছে ১৯-এ। রাইট-আর্ম পেসারদের আউটসুইংয়ের বিপক্ষে তার পাওয়ারপ্লে গড় ছিল ৬৩, এখন মাত্র ১৬।
লেফট-আর্ম পেসার মানেই বিপদ
২০১৪-২১ পর্যন্ত লেফট-আর্ম পেসারদের বিপক্ষে রোহিত আউট হয়েছেন ৭ বার, গড় ছিল ২৮.৮৫। কিন্তু ২০২২ থেকে এখন পর্যন্ত আউট হয়েছেন ৮ বার, গড় ২২.৩৭। আগের তুলনায় তিনি অনেক বেশি বলও খেলেছেন লেফট-আর্ম পেসারদের (১৩% থেকে বেড়ে ২৪%)।
স্পিনেও ধরেছে জড়তা
২০২২ সাল থেকে স্পিনারদের বিপক্ষে তার গড় ১৫.৩৩, যেখানে আগে ছিল ৩৪.৬৮। বিশেষ করে লেগ-স্পিনের বিপক্ষে রীতিমতো ধুঁকছেন, গড় মাত্র ৭.৮৮!

সুইপ শটে ধরা খাচ্ছেন বেশি
২০১৪-২০২১ পর্যন্ত সুইপ শট খেলতেন মাত্র ৭% সময়ে, আউট হয়েছিলেন ৮ বার। কিন্তু ২০২২ থেকে এই শট খেলছেন ২১% বলেই, আউট হয়েছেন ৬ বার, গড় ১৫.৫। শেষ ৩০টি সুইপ শট খেলেছেন সব ফরম্যাট মিলিয়ে, তাতে আউট হয়েছেন ৭ বার, গড় মাত্র ৭।
সব মিলিয়ে রোহিত শর্মার এই ব্যর্থতা হঠাৎ নয়, বরং তার ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ ও শট নির্বাচনে পরিবর্তনের ফল। ফর্মে ফেরা না গেলে হয়তো খুব শিগগিরই তাকে আইপিএলের ওপেনিং ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
এত সব হিসেবের ভিড়ে একটাই সত্য, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে, ‘হিটম্যান’-এর আইপিএল অধ্যায়ও হতে পারে নিস্তেজ এক সমাপ্তি।