ঢাকা | বঙ্গাব্দ

মরমি গীতিকবি হাছন রাজার বাড়িতে

  • আপলোড তারিখঃ 13-09-2024 ইং |
  • নিউজটি দেখেছেনঃ 162558 জন
মরমি গীতিকবি হাছন রাজার বাড়িতে ছবির ক্যাপশন: স্বাধীন ৭১
LaraTemplate

বিলাসী জমিদার হলেও তিনি নিজস্ব আরাম আয়েশের জন্যে কোনো সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করান নি। সুদর্শন সুপুরুষ হাছন রাজা ছিলেন পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ মোস্তফা আলী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন,

সুনামগঞ্জের তৎকালীন মুকুটহীন রাজা ছিলেন দেওয়ান হাছন রাজা, যেমন রাজা বংশ উপাধি ছিলো-- তেমনি রাজার মতোই তাঁকে দেখাতো, তিনি দীর্ঘকায় পুরুষ সিংহ ছিলেন। তাঁর বর্ণ তপ্তকাঞ্চনবৎ ছিলো--উন্নত নাসা, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল, মানানসই গোঁফ তাঁর আভিজাত্যের পরিচয় বহন করতো। আমি যখন তাঁকে দেখি তখন তাঁর কেশে ঘনকালো আভা। তিনি মখমলের পাজামা, চোগা চাপকান ও জরীর পাগড়ি ছাড়া বের হতেন না। তিনি বেশ কতদিন পরপর লোকজনসহ পদব্রজে নগর পরিভ্রমণে বের হতেন। এই অবস্থায়ই আমি তাঁকে দেখেছি।

তাঁর গানে রয়েছে মরমিয়তার নিরাভরণ সারল্য, ঐশিতার বিচ্ছুরণ। আপাতসাধারণ কথামালায়, চরণে চরণে প্রতিফলিত হয়েছে ভাটি অঞ্চলের লোকমানস, মাটি ও শেকড়ের আকুতির স্বতঃস্ফূর্ত, অপূর্ব সৌন্দর্য। অধ্যাত্মচেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আত্মআবিষ্কারের বিহ্বল আনন্দের তুঙ্গে উঠতে সমর্থ হয়েছিলেন এই লোককবি। তাঁর গানের গভীর ও মায়াবি বাণী, আকুলব্যাকুল সুরমূর্ছনা সহজেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় শ্রোতার অন্তর। ক্ষণিকের তরে হলেও এক ভাবালু অপার্থিবতার ভক্তিরসে আচ্ছন্ন করে তোলে শ্রোতার হৃদয়-মনন। মনের গভীর গহন কোণে অনিত্যতার সূক্ষ্ণ সংশয়ের অপার বেদনা আর্তি ও মায়ায় স্পর্শ করে। দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী (১৮৫৪-১৯২২) জন্মেছিলেন সুনামগঞ্জের তেঘরিয়ার লক্ষণশ্রী গ্রামে। জন্মতারিখ ১২৬১ বাংলা সনের ৭ পৌষ। ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ। মৃত্যু: ১৩২৩ বাংলা সনের ২২ অগ্রহায়ণ, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর।

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি পিতৃহীন হন। পৈতৃক জমিদারির যাবতীয় দায় দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। প্রাথমিক অবস্থায় নানাবিধ প্রতিকূলতা ছিল। সেগুলো তিনি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। ভোগবিলাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এই বিলাসিতার মধ্যে ছিল পশু পাখি পালন, এসবের পেছনে প্রচুর অর্থব্যয়, বেশ ঘটা ও আড়ম্বর করে নৌকা ভ্রমণে যাওয়া। নিজস্ব হেরেম ছিল না তাঁর। তিনি নৌকা ভ্রমণের সময় স্ত্রী, দাসদাসীদের সঙ্গে নিয়ে স্বরচিত গানের সঙ্গে আনন্দফুর্তি করতে ভালোবাসতেন।

বিলাসী জমিদার হলেও তিনি নিজস্ব আরাম আয়েশের জন্যে কোনো সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করান নি। লক্ষণশ্রীতে কেমন ছিল তাঁর নিজের বাড়ি? এর বর্ণনা আমরা পাই প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত লিখিত ‘হাছন রাজা গানের রাজা’ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন,

সুনামগঞ্জে শহরের লাগোয়া পশ্চিমে লক্ষণছিরি বা লক্ষণশ্রী গ্রামে, সুরমা নদীর দক্ষিণ দিকের তীরে ছিল হাছন রাজা সাহেবের ভদ্রাসন। কিন্তু তাঁর বাড়ি দেখলে কে বলবে সেটা কোন জমিদারের বাড়ি? দালানকোঠা না পাকা ঘরদোর? পল্লীগ্রামের সাধারণ গৃহস্থবাড়ির মতো তাঁরও ছিল মাটির ঘর, খড়ের চাল, কোনটা বা ঢেউ টিনের। তফাতের মধ্যে এই যে, ঘরগুলো ছিল বড় আকারের আর সংখ্যায় অনেকগুলো। বৈঠকখানা ঘরের চেহারাও ছিল তথৈবচ, আসবাবপত্রের মধ্যে একখানা সাধারণ তক্তপোষ তার উপরে পাতা ছেঁড়া শীতলপাটি বা জীর্ণ শতরঞ্চি,খান কয়েক নড়বড়ে চেয়ার, বেঞ্চি, টুল, টেবিল ইত্যাদি। সব মিলিয়ে যেন দীন দশার চেহারা, জমিদার বাড়ির কোনো জৌলুসের ছাপ ছিল না ঘরে বা ঘরের আসবাবপত্রে। কিন্তু পরিবেশটি ছিল মনোরম। বৈঠকখানার সামনেই পূর্ব দিকে খোলা মাঠের মত বড় উঠোন আর উত্তরদিকে সুরমা নদীর অবাধ জলস্রোত। 

গান লেখা ও সুরারোপ করা ছিল তাঁর অন্যতম শখ। আরও শখ ছিল মাছ ধরা, ঘোড়া পালন, পাখি পোষা, বড় বড় মেলার আয়োজন করা, দাবা খেলা ইত্যাদি। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘হাছন উদাস’, ‘সৌখিন বাহার’। দিনের চেয়ে রাতেই তিনি গান লিখতেন বেশি। সাধারণত মুখে মুখে গান রচনা করতেন এই মরমি কবি। কর্মচারীরা সঙ্গে সঙ্গে সেই গান লিখে নিতো। লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সুর দেওয়ার পালা। সুর দিতেন নিজেই। গায়ক-গায়িকারা তা গেয়ে শোনাতো। হাছন রাজা রচিত সংগীত পরিবেশনায় ব্যবহৃত হতো তবলা, ঢোলক, মন্দিরা, খটতাল, লাউয়া (একতারার অনুরূপ)। হিন্দিতেও গান লিখে গেছেন তিনি।

বাল্যকাল থেকেই এই গীতিকবি ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। আরবি ভাষা, বাংলা ভাষার পাঠ নিয়েছেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ছিল না। আধুনিক শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেননি, সেজন্যে হাছন রাজার মনে খেদ ছিল। শিক্ষা প্রসারে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসারেও তাঁর অবদান আছে।

হাছন রাজার বাড়ি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। সেই গল্পটি হলো: একদিন কয়েকজন ভদ্রলোক এলেন সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে। হাছন রাজার বাড়ি দেখবেন, এই তাদের প্রত্যাশা। সিলেটের এই জমিদারের বাড়ি নিশ্চয়ই নান্দনিক কিছু হবে, সুন্দর দালানকোঠা হবে-- এমন ধারণা ছিল তাদের। বাড়িতে আসার পথে হাছন রাজার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অভ্যাগতদের। হাছন রাজা তাদের আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। অতিথিরা তাকে চিনতে পারেন নি। তারা জানালেন কি কারণে এখানে এসেছেন। হাছন রাজা কি করলেন? বললেন, আমার সঙ্গে আসুন আপনারা। বাড়ির কাছেই কবরস্থানে নিয়ে গেলেন তাদের। মায়ের কবরের পাশে তাঁর নিজের কবর হবে--জায়গাটি নির্দিষ্ট করা আছে। হাছন রাজা সেই জায়গাটি দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ যে দেখুন আমার বাড়ি। আমার চিরদিনের আসল বাড়ি।’ বাড়িঘর নিয়ে তাঁর ব্যাকুলতা ছিল না। গানে তিনি বলছেন, ‘লোকে বলে লোকে বলে রে, ঘর বাড়ি ভালা নয় আমার।/ কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।/ ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর।/ আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার।/এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে।/ কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে।/ হাছন রাজায় বুঝতো যদি বাঁচব কত দিন।/দালান কোঠা বানাইত করিয়া রঙিন।

কবি রবীন্দ্রনাথ কি হাসন রাজার গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? এ প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। একটু আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অভিভাষণে (১৯২৫) এবং পরবর্তীতে লন্ডনে হিবার্ট বক্তৃতায় (১৯৩১) হাসন রাজার দু’টি গানের উল্লেখ করেছেন। ১৯২৫ সালের পূর্বেই মরমী কবির গান সংগ্রহ করেছেন বা শুনেছেন নিশ্চয়ই। ...

হাসন রাজার কাব্য পরিচিতি রবীন্দ্রনাথের গোচরে কিভাবে এসেছিলো, তার নেপথ্য ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন প্রভাত চন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘গানের রাজা হাসন রাজা’ বইতে। তাঁর ভাষ্যানুসারে; ‘হাসন রাজার কবিতা বা গান প্রথম রবীন্দ্রনাথের গোচরে এনেছিলেন প্রভাত কুমার শর্মা। প্রভাত কুমার মরমী কবি হাসন রাজার বেশ কিছু গান সংগ্রহ করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন সিলেটের মুরারি চাঁদ পত্রিকায় ১৯২৪ সালে (ভল্যুম ৮, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা)। এটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। তাতে প্রভাত কুমার উৎসাহিত হয়ে হাসন রাজার গানের সাহিত্যিক মূল্যায়নের বাসনায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য শান্তিনকেতনে যেতে মনস্থ করেন। ১৯২৫ সালে মে মাসের দিকে হাসন রাজার কয়েকটি গান নিয়ে রবীন্দ্র সান্নিধ্যলাভে শান্তিনিকেতনে রওয়ানা হন।।  

সৌভাগ্যবশত রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে তারই মধ্যস্থতায় প্রভাত কুমার আশ্রমে পৌঁছবার পরদিনই দর্শন পেলেন কবিগুরুর। নিজের উদ্দেশ্যের কথা সংক্ষেপে বলে প্রভাত কুমার হাসন রাজার আটখানি গান তুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথের হাতে। পরদিন সকালে যেতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ওহে পড়েছি গানগুলো। মনে হচ্ছে, একটা কিছু যেন বলতে চায় লোকটি, ঠিক ধরতে পারছি না, এত কম কবিতায় ধরা যায় না।’ তিনি আরো জানতে চেয়েছিলেন, এর কবিতা সম্বন্ধে কোথাও কোনো লেখা বেরিয়েছে কিনা। 

প্রভাত কুমার কলেজ ম্যাগাজিনে নিজের লেখার উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে, হাসন রাজার আরো অনেক গান তাঁর সংগ্রহে রয়েছে, সিলেটে গিয়ে পাঠিয়ে দেবেন, ব্যস এই পর্যন্তই। রবীন্দ্রনাথের বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছে সংকুচিত হয়ে সুদূর মফঃস্বল কলেজের মুখচোর তরুণ ছাত্রটি হাসন রাজা সম্পর্কে আর কিছুই বলতে পারেন নি। পরে সিলেটে ফিরে এসে প্রভাত কুমার নিজস্ব সংগ্রহ থেকে হাসন রাজার আরো ৭৫টি গান ডাকযোগে কবির কাছে পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনা ‘দেশ’ পত্রিকায় (২রা ফাল্গুন, ১৩৭৬) অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছিলো।”


✒️লেখকঃ 

মোঃ শামসুল আলম শিবলী

গন সংযোগ কর্মকর্তা, মাওলা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সন্তোষ, টাঙ্গাইল।


নিউজটি পোস্ট করেছেনঃ স্বাধীন ৭১

সর্বশেষ সংবাদ
notebook

কয়রার দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন